শনিবার, ২২ মার্চ ২০২৫, ০৩:২০ অপরাহ্ন
কুরআনুল কারিম মানুষের জন্য সেরা উপদেশ। আর মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ উপদেশের সুরা হিসেবে পরিচিত সুরা লোকমান। যেখানে বাবা তার সন্তানকে দুনিয়া ও পরকালের কল্যাণে উপদেশ দিচ্ছেন। আজকের ১৮ রোজার প্রস্তুতির তারাবিহতে পড়া হবে এ সুরা।
তাছাড়া কুরআন অধ্যয়ন ও অশ্লীল-গর্হিত কাজ থেকে বিরত থাকতে নামাজ প্রতিষ্ঠার নির্দেশে শুরু হবে ১৮ রোজার প্রস্তুতিতে রাতের নামাজ তারাবিহ। পড়া হবে ২১তম পারা। এ পারার শেষ দিকে বিশ্বনবির আদর্শ অনুসরণের ঘোষণা এসেছে। যে আদর্শ অনুসরণে সফল হবে মুমিন। আল্লাহ তাআলা বলেন-
‘যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্য রাসুলুল্লাহর মধ্যে উত্তম নমুনা রয়েছে।’ (সুরা আহযাব : আয়াত ২১)
আজকের তারাবিহতে সুরা আনকাবুতের শেষাংশ, সুরা রুম, সুরা লোকমান, সুরা সাজদা এবং সুরা আহযাবের প্রথম ৩০ আয়াত পড়া হবে। সুরা আনকাবুতে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন-
‘(হে রাসুল!) আপনি আপনার প্রতি নাজিল হওয়া কিতাব পাঠ করুন এবং নামাজ প্রতিষ্ঠা করুন। নিশ্চয় নামাজ অশ্লীল ও গর্হিত কাজ থেকে বিরত রাখে। আল্লাহর স্মরণ সর্বশ্রেষ্ঠ। আল্লাহ জানেন তোমরা যা কর।’ (সুরা আনকাবুত : আয়াত ৪৫)
এ সুরায় আল্লাহ তাআলা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শ্রেষ্ঠ মুজিজার বর্ণনা দিয়েছেন। প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিরক্ষর হওয়া। অথচ তাঁর প্রতি নাজিল করেছেন সর্বকালের সর্বযুগের সেরা আসমানি গ্রন্থ কুরআনুল কারিম। আল্লাহ তাআলা বলেন-
‘আপনি তো এর আগে কোনো কিতাব পাঠ করেননি এবং স্বীয় হাত দ্বারা কোনো কিতাব লেখেননি; তাহলে মিথ্যাবাদীরা অবশ্যই সন্দেহ পোষণ করত। বরং যাদেরকে জ্ঞান দেয়া হয়েছে, তাদের অন্তরে ইহা (কুরআন) তো সুস্পষ্ট আয়াত। কেবল বে-ইনসাফরাই আমার আয়াতসমূহ অস্বীকার করে। ’ (সুরা আনকাবুত : আয়াত ৪৮-৪৯)
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোনো লেখাই দেখে দেখে পড়তে পারতেন না। কোনো লেখা লিখতেও সক্ষম ছিলেন। আর এ নিরক্ষর অবস্থায়ই প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর জীবনের প্রথম ৪০টি বছর পণ্ডিত মক্কাবাসীর সামনে অতিবাহিত করেন।
প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনো আসমানি কিতাবের অনুসারীদের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখেননি। তাদের কাছ থেকে আসমানি কিতাবের কোনো বর্ণনাও শোনেননি। আর তৎকালিন সময়ে মক্কায় কোনো আসমানি কিতাবের অনুসারী পণ্ডিত ব্যক্তিবর্গও ছিল না।
অথচ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ৪০ বছরে উপনীত হওয়ার পর তাঁর মুখ থেকে এমন শব্দমালা উচ্চারিত হতে লাগলো, যা বিষয়বস্তু ও অর্থের দিক থেকে যেমন ছিল মুজিজাস্বরূপ এবং ভাষাগত শাব্দিক বিশুদ্ধতা ও ভাষার সৌন্দর্য ছিল অতুলনীয়।
বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিরক্ষরতাই ছিল তৎকালীন সময়ের সর্বশ্রেষ্ঠ মুজিজা। যা মক্কার পণ্ডিত ব্যক্তিবর্গের জন্য ছিল এক মহা চিন্তা ও শিক্ষার বিষয়। আর এটা ছিল তাওহিদ, রেসালাত ও আখেরাতের সত্যতার ওপর বিশ্বাস স্থাপনের এক মহা প্রমাণ। এ কুরআনই বিশ্ববাসীর জন্য রহমত। আল্লাহ তাআলা বলেন-
‘এটা কি তাদের জন্য যথেষ্ট নয় যে, আমি আপনার প্রতি কিতাব নাজিল করেছি, যা তাদের কাছে পাঠ করা হয়। এতে অবশ্যই বিশ্বাসী লোকদের জন্য রয়েছে রহমত ও উপদেশ।’ (সুরা আনকাবুত : আয়াত ৫১)
ঈমানদারদের প্রতি ইবাদত করার ঘোষণা ও সুনিশ্চিত মৃত্যুর ঘোষণা এসেছে। যেন তারা আল্লাহকে রব বলে স্বীকার করে। কেননা তাদের সবাইকে একদিন ফিরে যেতে হবে। আল্লাহ বলেন-
‘হে আমার ঈমানদার বান্দাগণ, আমার পৃথিবী প্রশস্ত। অতএব তোমরা আমারই এবাদত কর। জীবমাত্রই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে। অতঃপর তোমরা আমারই কাছে প্রত্যাবর্তিত হবে।’ (সুরা আনকাবুত : আয়াত ৫৬-৫৭)
সুরা রূম (৬০)
মক্কায় অবতীর্ণ ৬০ আয়াত বিশিষ্ট সুরায় বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুয়ত কেন্দ্রিক আলোচনা ওঠে এসেছে। যাতে নবুয়তের সত্যতার দলিল প্রমাণ উপস্থাপিত হয়েছে।
প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রোমানদের বিজয়ের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন এবং এ সম্পর্কে কুরআনের আয়াতও নাজিল হয়েছিল। অবশেষে এ ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে সত্য প্রমাণিত হয়েছে এ সুরায়। সুরাটিতে দুনিয়ার জীবনের ব্যাপ্তি নিতান্ত ক্ষণস্থায়ী উল্লেখ করে আল্লাহ বলেন- ‘তিনি যাকে ইচ্ছা বিজয় দান করেন আবার সেই বিজয়ীকে পরাজিতও করেন।’ এতেই প্রমাণিত হয় যে, কারো বিজয় তার সত্যতার প্রমাণ নয়।
দুনিয়ার জীবনের সম্মান-মর্যাদা, অপমান সবাই আল্লাহর কর্তৃত্বাধীন। এরপরও অবিশ্বাসী সম্প্রদায় মুসলমানদের সাময়িক সময়ের দারিদ্র্যতার জন্য হেয় প্রতিপন্ন করে। যা সবিস্তার আলোচিত হয়েছে সুরা রূমে। এ সুরার আলোচ্য বিষয়গুলো হলো-
> পরকাল বিমুখ হয়ে জ্ঞানী হওয়া বুদ্ধিমত্তার পরিচয় নয়; > বৈবাহিক জীবনে শান্তির জন্য পারস্পারিক সম্প্রীতি জরুরি। আল্লাহ তাআলা বলেন-
‘আর এক নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদের জন্যে তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের সংগিনীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তিতে থাক এবং তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয় এতে চিন্তাশীল লোকদের জন্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে। তাঁর আর ও এক নিদর্শন হচ্ছে নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের সৃজন এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র। নিশ্চয় এতে জ্ঞানীদের জন্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে।’ ‘ (সুরা রূম : আয়াত ২১)
> ফিতরাত সম্পর্কিত আলোচনা। > বাতিলপন্থীদের ভ্রান্ত পরিবেশ থেকে দূরে থাকা প্রসঙ্গ। > পরকালের (হাশরে) আল্লাহর সামনে মিথ্যা বলা প্রসঙ্গ। আল্লাহ বলেন-
– ‘তুমি একনিষ্ঠ ভাবে নিজেকে ধর্মের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখ। এটাই আল্লাহর ফিতরাত বা প্রকৃতি, যার উপর তিনি মানব সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর সৃষ্টির কোনো পরিবর্তন নেই। এটাই সরল ধর্ম। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানে না। সবাই তাঁর অভিমুখী হও এবং ভয় কর, নামায কায়েম কর এবং মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না।’ (সুরা রূম : আয়াত ৩০-৩১)
– ‘অতএব, আপনি মৃতদেরকে শোনাতে পারবেন না এবং বধিরকেও আহবান শোনাতে পারবেন না, যখন তারা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে। আপনি অন্ধদেরও তাদের পথভ্রষ্টতা থেকে পথ দেখাতে পারবেন না। আপনি কেবল তাদেরই শোনাতে পারবেন, যারা আমার আয়াতসমূহে বিশ্বাস করে। কারণ তারা মুসলমান।’ (সুরা রূম ৩০:৫২-৫৩)
– ‘যেদিন কেয়ামত সংঘটিত হবে, সেদিন অপরাধীরা কসম খেয়ে বলবে যে, এক মুহুর্তেরও বেশী অবস্থান করিনি। এমনিভাবে তারা সত্যবিমুখ হত। যাদের জ্ঞান ও ঈমান দেয়া হয়েছে, তারা বলবে আমরা আল্লাহর কিতাব মতে পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত অবস্থান করেছি। এটাই পুনরুত্থান দিবস, কিন্তু তোমরা তা জানতে না।’ (সুরা রূম : আয়াত ৫৫-৫৬)
সুরাটির শেষে আল্লাহ তাআলা প্রিয় নবিকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন-
‘এমনিভাবে আল্লাহ জ্ঞানহীনদের হৃদয় মোহরাঙ্কিত করে দেন। অতএব, আপনি সবর করুন। আল্লাহর ওয়াদা সত্য। যারা বিশ্বাসী নয়, তারা যেন আপনাকে বিচলিত করতে না পারে।’ (সুরা রূম : আয়াত ৫৯-৬০)
সুরা লোকমান (৩৪)
মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ উপদেশের সুরা হিসেবে পরিচিত সুরা লোকমান। যেখানে বাবা তার সন্তানকে দুনিয়া ও পরকালের কল্যাণে উপদেশ দিচ্ছেন। সুরাটিতে ৩৪ আয়াত ও ৪টি রুকু রয়েছে। সুরাটি মক্কায় অবতীর্ণ।
অনেক জ্ঞানের অধিকারী লোকমান হাকিমের বিস্তারিত ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে এ সুরায়। আল্লাহ তাআলা মানুষের জন্য অনেক বিধান নির্ধারণ করেছেন। তাছাড়া একজন পিতা তার সন্তানকে যে উপদেশ দেয়া উচিত; তাও বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে। এ সুরার আলোচ্য বিষয়গুলো হলো-
আল্লাহর নাফরমানি থেকে বিরত থাকা জরুরি। নাফরমানির শাস্তি শুধুমাত্র আখিরাতে নয়, দুনিয়াতেও হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন-
‘ একশ্রেণীর লোক আছে যারা মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে গোমরাহ করার উদ্দেশে অবান্তর কথাবার্তা সংগ্রহ করে অন্ধভাবে এবং উহাকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্ রূপ করে। এদের জন্য রয়েছে অবমাননাকর শাস্তি। যখন ওদের সামনে আমার আয়তসমূহ পাঠ করা হয়, তখন ওরা দম্ভের সাথে এমনভাবে মুখ ফিরিয়ে নেয়, যেন ওরা তা শুনতেই পায়নি অথবা যেন ওদের দু’কান বধির। সুতরাং ওদেরকে কষ্টদায়ক আযাবের সংবাদ দাও।’ (সুরা লুকমান : আয়াত ৬-৭)
> হজরত লোকমানকে প্রদত্ত হিকমতের বর্ণনা ও হজরত লোকমান কর্তৃক উপদেশ। আল্লাহ বলেন-
– ‘আমি লোকমানকে প্রজ্ঞা দান করেছি এই মর্মে যে, আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ হও। যে কৃতজ্ঞ হয়, সে তো কেবল নিজ কল্যাণের জন্যই কৃতজ্ঞ হয়। আর যে অকৃতজ্ঞ হয়, আল্লাহ অভাবমুক্ত, প্রশংসিত। আমি লোকমানকে প্রজ্ঞা দান করেছি এই মর্মে যে, আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ হও। যে কৃতজ্ঞ হয়, সে তো কেবল নিজ কল্যানের জন্যই কৃতজ্ঞ হয়। আর যে অকৃতজ্ঞ হয়, আল্লাহ অভাবমুক্ত, প্রশংসিত।’ (সুরা লোকমান : ১২-১৩)
– ‘আর আমি মানুষকে তার পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহারের জোর নির্দেশ দিয়েছি। তার মাতা তাকে কষ্টের পর কষ্ট করে গর্ভে ধারণ করেছে। তার দুধ ছাড়ানো দু বছরে হয়। নির্দেশ দিয়েছি যে, আমার প্রতি ও তোমার পিতা-মতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। অবশেষে আমারই নিকট ফিরে আসতে হবে।’ (সুরা লোকমান : আয়াত ১৪)
– ‘পিতা-মাতা যদি তোমাকে আমার সাথে এমন বিষয়কে শরিক স্থির করতে পীড়াপীড়ি করে, যার জ্ঞান তোমার নেই; তবে তুমি তাদের কথা মানবে না এবং দুনিয়াতে তাদের সাথে সদ্ভাবে সহঅবস্থান করবে। যে আমার অভিমুখী হয়, তার পথ অনুসরণ করবে। অতপর তোমাদের প্রত্যাবর্তন আমারই দিকে এবং তোমরা যা করতে, আমি সে বিষয়ে তোমাদেরকে জ্ঞাত করবো।’ (সুরা লোকমান : আয়াত ১৫)
– ‘হে ছেলে, কোনো বস্তু যদি সরিষার দানা পরিমাণও হয় অতপর তা যদি থাকে প্রস্তর গর্ভে অথবা আকাশে অথবা ভূ-গর্ভে, তবে আল্লাহ তাও উপস্থিত করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ গোপন ভেদ জানেন, সবকিছুর খবর রাখেন।’ (সুরা লোকমান : আয়াত ১৬)
– ‘হে বৎস, নামাজ প্রতিষ্ঠা কর, সৎকাজে আদেশ দাও, মন্দকাজে নিষেধ কর এবং বিপদাপদে সবর কর। নিশ্চয় এটা সাহসিকতার কাজ। অহংকারবশে তুমি মানুষকে অবজ্ঞা করো না এবং পৃথিবীতে গর্বভরে পদচারণ করো না। নিশ্চয় আল্লাহ কোন দাম্ভিক অহংকারীকে পছন্দ করেন না। পদচারণায় মধ্যবর্তিতা অবলম্বন কর এবং কন্ঠস্বর নীচু কর। নিঃসন্দেহে গাধার স্বরই সর্বাপেক্ষা অপ্রীতিকর।’ (সুরা লুকমান : আয়াত ১৭-১৯)
> ইসলামের অন্যান্য নীতি সম্পর্কিত আল্লাহ তাআলা বলেন-
‘হে মানব জাতি! তোমরা তোমাদের পালনকর্তাকে ভয় কর এবং ভয় কর এমন এক দিবসকে, যখন পিতা পুত্রের কোন কাজে আসবে না এবং পুত্রও তার পিতার কোন উপকার করতে পারবে না। নিঃসন্দেহে আল্লাহর ওয়াদা সত্য। অতএব, পার্থিব জীবন যেন তোমাদেরকে ধোঁকা না দেয় এবং আল্লাহ সম্পর্কে প্রতারক শয়তানও যেন তোমাদেরকে প্রতারিত না করে। নিশ্চয় আল্লাহর কাছেই কেয়ামতের জ্ঞান রয়েছে। তিনিই বৃষ্টি বর্ষণ করেন এবং গর্ভাশয়ে যা থাকে, তিনি তা জানেন। কেউ জানে না আগামীকল্য সে কি উপার্জন করবে এবং কেউ জানে না কোন দেশে সে মৃত্যুবরণ করবে। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সর্ববিষয়ে সম্যক জ্ঞাত।’ (সুরা লুকমান ৩১:৩৩-৩৪)
সুরা আস-সাজদাহ (১-৩০)
মক্কায় নাজিল হওয়া ৩০ আয়াত বিশিষ্ট সুরা ‘আস-সাজদাহ’। পবিত্র কুরআনের সত্যতার বিবরণ স্থান লাভ করেছে এ সুরায়। তাছাড়া আল্লাহর একত্ববাদ, পরকাল ও পরকালীন জীবন সম্পর্কিত আলোচনাও স্থান পেয়েছে। সুরা লোকমানে আসমান-জমিন সৃষ্টির বর্ণনা করা হয়েছে। আর এ সুরায় বিশ্বসৃষ্টির ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। এ সুরার আলোচ্য বিষয়গুলো হলো-
> কিয়ামাত দিবসের দৈর্ঘ্য সম্পর্কিত আলোচনা। আল্লাহ বলেন-
‘আল্লাহ যিনি নভোমন্ডল, ভুমন্ডল ও এতদুভয়ের মধ্যবর্তী সবকিছু ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন, অতপর তিনি আরশে বিরাজমান হয়েছেন। তিনি ব্যতিত তোমাদের কোনো অভিভাবক ও সুপারিশকারী নেই। এরপরও কি তোমরা বুঝবে না? তিনি আকাশ থেকে পৃথিবী পর্যন্ত সমস্ত কর্ম পরিচালনা করেন, অতপর তা তাঁর কাছে পৌছবে এমন এক দিনে, যার পরিমাণ তোমাদের গণনায় হাজার বছরের সমান।’ (সুরা আস-সাজদাহ : আয়াত ৪-৫)
> মালাকুল মাউত সম্পর্কিত আলোচনা। আল্লাহ বলেন-
‘যিনি তাঁর প্রত্যেকটি সৃষ্টিকে সুন্দর করেছেন এবং কাদামাটি থেকে মানব সৃষ্টির সূচনা করেছেন। অতপর তিনি তার বংশধর সৃষ্টি করেন তুচ্ছ পানির নির্যাস থেকে। অতপর তিনি তাকে সুষম করেন, তাতে রূহ সঞ্চার করেন এবং তোমাদেরকে দেন কর্ণ, চক্ষু ও অন্তঃকরণ। তোমরা সামান্যই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। তারা বলে, আমরা মৃত্তিকায় মিশ্রিত হয়ে গেলেও পুনরায় নতুন করে সৃজিত হব কি? বরং তারা তাদের পালনকর্তার সাক্ষাতকে অস্বীকার করে। বলুন, তোমাদের প্রাণ হরণের দায়িত্বে নিয়োজিত ফেরেশতা তোমাদের প্রাণ হরণ করবে। অতপর তোমরা তোমাদের পালনকর্তার কাছে প্রত্যাবর্তিত হবে।’ (সুরা আস-সাজদাহ : আয়াত ৭-১১)
> মুমিনের গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্য আলোচনা। আল্লাহ বলেন-
‘কেবল তারাই আমার আয়াতসমূহের প্রতি ঈমান আনে, যারা আয়াতসমূহ দ্বারা উপদেশপ্রাপ্ত হয়ে সেজদায় লুটিয়ে পড়ে এবং অহংকারমুক্ত হয়ে তাদের পালনকর্তার সপ্রশংস পবিত্রতা বর্ণনা করে। তাদের পার্শ্ব শয্যা থেকে আলাদা থাকে। তারা তাদের পালনকর্তাকে ডাকে ভয়ে ও আশায় এবং আমি তাদেরকে যে রিযিক দিয়েছি, তা থেকে ব্যয় করে। কেউ জানে না তার জন্যে কৃতকর্মের কি কি নয়ন-প্রীতি কর প্রতিদান লুক্কায়িত আছে। ঈমানদার ব্যক্তি কি অবাধ্যের অনুরূপ? তারা সমান নয়। যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে, তাদের জন্যে রয়েছে তাদের কৃতকর্মের আপ্যায়নস্বরূপ বসবাসের জান্নাত।’ (সুরা আস-সাজদাহ : আয়াত ১৫-১৯)
> ভূমিতে পানি প্রবাহ সম্পর্কিত আলোচনা। আল্লাহ বলেন-
‘তারা কি লক্ষ্য করে না যে, আমি উষর ভূমিতে পানি প্রবাহিত করে শস্য উদগত করি, যা থেকে ভক্ষণ করে তাদের জন্তুরা এবং তারা কি দেখে না?’ (সুরা আস-সাজদাহ : আয়াত ২৭)
সুরা আহযাব (১-৩০)
সুরা আহযাব মদিনায় অবতীর্ণ। আহযাব মানে দল, যেহেতু কাফেররা পঞ্চম হিজরিতে যুক্তফ্রন্ট করে ঐক্যবদ্ধভাবে মুসলমানদের হৃদয়ে স্পন্দন মদিনার ইসলামি রাষ্ট্রকে সমূলে বিনষ্ট করার মানসে আক্রমণ করেছিল। এ সুরায় সেই যুদ্ধের আলোচনাই বর্ণনা করা হয়েছে।
> তাকওয়া ও পরহেজগারীর গুণ অর্জন করা। সুরার শুরুতেই আল্লাহ তাআলাকে ভয় করার এবং তাকে অনুসরণ করার কথা তুলে ধরে বলেন-
‘হে নবি! আল্লাহকে ভয় করুন এবং কাফের ও কপট বিশ্বাসীদের কথা মানবেন না। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। আপনার পালনকর্তার পক্ষ থেকে যা অবতীর্ণ হয়, আপনি তার অনুসরণ করুন। নিশ্চয় তোমরা যা কর, আল্লাহ সে বিষয়ে খবর রাখেন। আপনি আল্লাহর উপর ভরসা করুন। কার্যনির্বাহীরূপে আল্লাহই যথেষ্ট।’ (সুরা আহযাব : আয়াত ১-৩)
> আল্লাহ তাআলা মানুষকে পিতৃ পরিচয়ে ডাকার কথা তুলে ধরে বলেন-
– ‘আল্লাহ কোন মানুষের মধ্যে দুটি হৃদয় স্থাপন করেননি। তোমাদের স্ত্রীগণ যাদের সাথে তোমরা যিহার কর, তাদেরকে তোমাদের জননী করেননি এবং তোমাদের পোষ্যপুত্রদেরকে তোমাদের পুত্র করেননি। এগুলো তোমাদের মুখের কথা মাত্র। আল্লাহ ন্যায় কথা বলেন এবং পথ প্রদর্শন করেন। তোমরা তাদেরকে তাদের পিতৃপরিচয়ে ডাক। এটাই আল্লাহর কাছে ন্যায়সঙ্গত। যদি তোমরা তাদের পিতৃ-পরিচয় না জান, তবে তারা তোমাদের ধর্মীয় ভাই ও বন্ধুরূপে গণ্য হবে। এ ব্যাপারে তোমাদের কোন বিচ্যুতি হলে তাতে তোমাদের কোন গোনাহ নেই, তবে ইচ্ছাকৃত হলে ভিন্ন কথা। আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সুরা আহযাব : আয়াত ৪-৫)
> আল্লাহ ব্যতিত অন্য কাউকে ভয় না করা। আল্লাহ বলেন-
‘বলুন! কে তোমাদেরকে আল্লাহ থেকে রক্ষা করবে যদি তিনি তোমাদের অমঙ্গল ইচ্ছা করেন অথবা তোমাদের প্রতি অনুকম্পার ইচ্ছা? তারা আল্লাহ ব্যতীত নিজেদের কোন অভিভাবক ও সাহায্যদাতা পাবে না।’ (সুরা আহযাব : আয়াত ১৭)
> রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুসলিম উম্মাহর জন্য সর্বোত্তম আদর্শ। যে আদর্শ পালনে মানুষ থাকবে দুনিয়া ও পরকালে নিরাপদ। আল্লাহ বলেন-
‘যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্যে রসূলুল্লাহর মধ্যে উত্তম নমুনা রয়েছে। যখন মুমিনরা শক্রবাহিনীকে দেখল, তখন বলল, আল্লাহ ও তাঁর রসূল এরই ওয়াদা আমাদেরকে দিয়েছিলেন এবং আল্লাহ ও তাঁর রসূল সত্য বলেছেন। এতে তাদের ঈমান ও আত্নসমর্পণই বৃদ্ধি পেল। মুমিনদের মধ্যে কতক আল্লাহর সাথে কৃত ওয়াদা পূর্ণ করেছে। তাদের কেউ কেউ মৃত্যুবরণ করেছে এবং কেউ কেউ প্রতীক্ষা করছে। তারা তাদের সংকল্প মোটেই পরিবর্তন করেনি।’ (সুরা আহযাব : আয়াত ২১-২৩)
> আল্লাহ মুমিনদের সহযোগিতা করেন আর অবিশ্বাসীরা হয় বঞ্চিত। আল্লাহ বলেন-
‘এটা এজন্য যাতে আল্লাহ, সত্যবাদীদেরকে তাদের সত্যবাদিতার কারণে প্রতিদান দেন এবং ইচ্ছা করলে মুনাফেকদেরকে শাস্তি দেন অথবা ক্ষমা করেন। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। আল্লাহ কাফেরদেরকে ক্রুদ্ধাবস্থায় ফিরিয়ে দিলেন। তারা কোন কল্যাণ পায়নি। যুদ্ধ করার জন্য আল্লাহ মুমিনদের জন্যে যথেষ্ট হয়ে গেছেন। আল্লাহ শক্তিধর, পরাক্রমশালী।’ (সুরা আহযাব : আয়াত ২৪-২৫)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে কুরআনের এ গুরুত্বপূর্ণ সুরাগুলো বুঝে পড়ার এবং তার ওপর আমল করার পাশাপাশি নিজেদের আকিদা-বিশ্বাসকে শিরকমুক্ত রাখার তাওফিক দান করুন। তাওহিদ রেসালাত ও আখেরাতের প্রতি পরিপূর্ণ বিশ্বাস স্থাপনে মাধ্যমে প্রকৃত মুমিন হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।